অতিমারি সময়ে ডিম একটি প্রোটিন ক্যাপসুল
কৃষিবিদ মোঃ ফজলুল করিম
করোনাকালে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিম রাখার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে বহুগুণ। মূলত করোনা প্রতিরোধ, করোনা মোকাবিলা ও চিকিৎসা এবং করোনা-পরবর্তী যত্নের নিরিখেই ডিমের চাহিদা সারা বিশ্বে বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। পোলট্রি শিল্পের মালিক ও শ্রমিকদের এ ক্ষেত্রে সাধুবাদ দেয়া উচিত। কারণ, সব প্রতিকূলতা, সংক্রমণ ও লকডাউনের মধ্যে তাঁরা দুনিয়াজুড়ে এই ডিমের চাহিদা পূরণ করে চলেছেন। মূলত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ডিমের চাহিদা ও ব্যবহার এ রকম আশাতীতভাবে বাড়ার কারণগুলোর দিকে এবার একটু চোখ বোলানো যাক।
সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ডিম উৎপাদিত হয়। ডিম খাওয়ার ব্যাপারে জাপানিরা সবচেয়ে এগিয়ে আছে। তারা প্রত্যেকে গড়ে প্রতি বছর ৩২০টি ডিম খেয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম, প্রায় ১০৩টি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে অন্য যেকোনো প্রাণিজ আমিষের চেয়ে ডিমের আধিপত্য বেশি ঘরে ঘরে। দামে কম, বেশি পুষ্টিকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মহামারির সময়ে প্রোটিন বুস্ট পাওয়ার প্রধান উপায়ই হচ্ছে ডিম খাওয়া।
যুগে যুগে মানুষের আমিষ জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎসগুলোর একটি হয়ে আছে ডিম। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম কীভাবে মানুষের মনে মা পাখির রক্তচক্ষু এড়িয়ে পাখির বাসা থেকে এই প্রায় গোলাকৃতি বস্তু ফাটিয়ে ভেতরের উপাদেয় অংশ খাবার কথা মাথায় এলো, তা সত্যি নৃতাত্তিক গবেষণার ব্যাপার। তবে এই ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে ছেলে-বুড়ো সবার জন্য সহজলভ্য ও সহজপাচ্য এই প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের জুড়ি মেলা ভার। তাই বলি-খেতে সোজা রাঁধতে ভালো, ডিম ছাড়া আর কি বলো?
পুষ্টিগুণ
পুষ্টিগুণের দিক থেকে অত্যন্ত উন্নতমানের প্রোটিন সরবরাহ করে ডিম। লকডাউন এবং উৎপাদন বা পরিবহণ-সংকটের সময় কাঁচা মাছ মাংসের তুলনায় ডিম সহজে পাওয়া যায়। কম পচনশীল বলে এর পরিবহণ অপেক্ষাকৃত সহজ। পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। অন্য যেকোনো প্রাণিজ প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের চেয়ে ডিম দামে সস্তা। অথচ পুষ্টিগুণের দিক থেকে অত্যন্ত উন্নতমানের প্রোটিন সরবরাহ করে আমাদের দৈনিক চাহিদার পুরোটাই ডিম পূরণ করতে পারে। প্রোটিনের রাসায়নিক রূপ, অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রায় সব ক’টিই এই এক ডিমের ভেতরেই আছে। প্রোটিন ছাড়াও অন্যান্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানের ভালো উৎস ডিম। এতে আছে মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, বি ফাইভ, বি টুয়েলভ, ফসফরাস, সেলেনিয়ামসহ আরো অনেক খাদ্য উপাদান। এ জন্যই ডিমকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়। ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে যে গুটিকয়েক খাদ্যের মধ্যে উপস্থিত, ডিম তাদের মধ্যে অন্যতম। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, রক্তের ভালো কোলেস্টেরল এই ডিমে উপস্থিত থাকে। ডিমের উপকারী চর্বি মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালাতে সাহায্য করে, ফ্যাট সলিউবল ভিটামিনকে মানবদেহে শোষিত হতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি দুই-ই থাকায় ডিম হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধি এবং গঠনের জন্য খুবই উপকারী।
সর্বজনীন পুষ্টির উৎস
ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই ডিম জরুরি প্রোটিন উৎস হিসেবে বিবেচিত। তাই করোনার এই দিনে পরিবারের সবার প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাতে ডিমের জুড়ি মেলা ভার। খেতে সুবিধাজনক ও সুস্বাদু বলে শিশুদের কাছে ডিম খুব পছন্দের। জন্মের পর শিশু যখন প্রথম শক্ত খাবার খেতে শুরু করে, তখন প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মাছ বা মাংসের আগে তাকে ডিমই দেয়া হয়। ডিম দিয়ে তৈরি করা যায় অসংখ্য উপাদেয়, বৈচিত্র্যময় খাবার। মিষ্টি, ঝাল অথবা নোনতা, চুলায় অথবা ওভেনে ডিম দিয়ে বানানো যায় হাজারো মজাদার খাবার। ডিমের সাদা অংশে বেশির ভাগ প্রোটিন থাকলেও হৃদরোগ বা খুব উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা না থাকলে সব সময় সেলেনিয়ামসমৃদ্ধ কুসুম বাদ দেয়া উচিত নয়। সব বয়সের মানুষের জন্য ডিম জরুরি প্রোটিন উৎস হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎসকেরা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সময় তাদের দিনে একাধিক ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। দেহের ক্ষয়পূরণ, নতুন কোষ গঠন, দুর্বল শরীরে শক্তির সঞ্চার প্রভৃতি সব ধরনের ক্ষতিপূরণ করতে ডিম খাওয়া খুবই প্রয়োজন। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখার কোনো বিকল্প নেই এই মহামারির সময়ে। ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো থাকলে করোনা ভাইরাসসহ যেকোনো সংক্রমণের ভয়াবহতা কম হয় শরীরে। প্রমাণ মিলেছে, ইমিউন সিস্টেমের প্রধান উপাদান দেহের অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডির প্রধান উপাদান প্রোটিন। এ জন্য প্রতিদিন ডিম খেলে করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো থাকে শরীরে। পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টই দেখা যায়, বিশ্বের সব দেশেই ডিমের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার গত বছর হু হু করে বেড়েছে আকাশচুম্বী হারে। করোনাকালে নিশ্চিত পুষ্টি আর বাজেটে স্বস্তি দিয়েছে প্রোটিন প্যাকস্বরূপ ডিম। লকডাউনের দুর্দিনে বাড়িতে অন্য কিছু না থাকলেও খিচুড়ি বা ভাত-ডালের সঙ্গে ডিম-আলু হলেই চলে গেছে। এখন লকডাউনের কড়াকড়ি না থাকলেও করোনা মোকাবিলা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে আমাদের জীবনে ডিমের গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি।
ডিমের খোসার গুরুত্ব
ডিমের খোসায় রয়েছে বৈচিত্র্যময় উপযোগিতা আর বহুমুখী ব্যবহার। ডিমের খোসা ক্যালসিয়ামের অফুরন্ত খনি। আমাদের দেশে ছোট-বড় সবার প্রায়ই ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি হয়। বিশেষত গিঁটেবাত, হাড়ের ক্ষয়, হাড় ফাঁপা হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন ব্যথা-বেদনা, ভঙ্গুর দাঁত ও নখ ইত্যাদি রোগে দেশের শিশু ও বয়স্ক জনগণের একটি বিরাট অংশ ভুগে থাকে। অথচ অত্যন্ত কম খরচে ডিমের খোসা থেকে তৈরি ক্যালসিয়াম পাউডার আমাদের দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা সম্পূর্ণভাবে মেটাতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, সঠিকভাবে প্রস্তুতকৃত এক চা-চামচ ডিমের খোসার চূর্ণতে আছে ৮০০-১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। আর একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনে ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়ের জন্য এই প্রয়োজনের পরিমাণ আরও বেশি। অথচ ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস হিসেবে জনপ্রিয় দুধে এই উপাদান থাকে প্রতি এক কাপে মাত্র ৩০০-৪০০মিলিগ্রাম। বর্তমানে এই বিষয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। তাছাড়াও ডিমের খোসা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। য়
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা। মোবাইল : ০১৭২৪-১৪১৬৬২, ই-মেইল : fazlurahi@gmail.com